• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

বরিশাল প্রতিবেদন
ব্রেকিং:
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে: রাষ্ট্রপতি শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা গুরুত্বপূর্ণ: প্রধানমন্ত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশুপালন ও মাংস প্রক্রিয়াকরণের তাগিদ জাতির পিতা বেঁচে থাকলে বহু আগেই বাংলাদেশ আরও উন্নত হতো মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার প্রতি নজর রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রী আজ প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ উদ্বোধন করবেন মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব না খাটানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর দলের নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানায় শেখ হাসিনা মুজিবনগর দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারবে মুজিবনগর দিবস বাঙালির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন: প্রধানমন্ত্রী ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ নতুন বছর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাবে : প্রধানমন্ত্রী আ.লীগ ক্ষমতায় আসে জনগণকে দিতে, আর বিএনপি আসে নিতে: প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা রাষ্ট্রপতির দেশবাসী ও মুসলিম উম্মাহকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কিশোর অপরাধীদের মোকাবেলায় বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের প্রতি বিএনপির কোনো দায়বদ্ধতা নেই : ওবায়দুল কাদের

মধ্য রাতে কামানের বিকট শব্দে জেগে উঠলো বরিশালবাসী!

বরিশাল প্রতিবেদন

প্রকাশিত: ২১ নভেম্বর ২০১৯  

শীতের আমেজ জেঁকে বসেছে সবদিকে। হালকা ফিনফিনে হাওয়ায় তাই বাড়ির বাইরে খুব বেশি লোকের ভিড় নেই। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেছে। চারিদিকে শুনশান নীরবতা।

অনেকের চোখেই তখন ঘুম ঘুম ভাব। প্রতিটি ঘরের আলোও একে একে নিভে আসছে। এমনই সময় চারপাশ সচকিত করা এক বিকট শব্দ। তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল বরিশাল এলাকার অনেক মানুষের। সাড়া পড়ে গেল চারিদিকে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, গগনবিদারী এই আওয়াজ কীসের? 

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা এটি। বাংলাদেশ নামটার অস্তিত্ব তখন ছিল না, সেটা বলাই বাহুল্য। পুরো ভারতবর্ষে তখন ইংরেজদের আধিপত্য। সালের হিসেবে সেটি ১৮৭০ সালের আশেপাশে। আচমকা শব্দটি শুনে ভয় এবং চমকের অভিব্যক্তিতে সবার চোখ যেন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উদগ্রীব। আর বরিশালের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঘটা এই বিকট শব্দগুলোর নামই হলো ‘বরিশাল গানস’ বা ‘গানস অব বরিশাল‘।

সে সময় বরিশালের পূর্বনাম ছিল নাম ছিল বাকেরগঞ্জ। তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়! পরদিন আবার ঠিক একই সময়ে শুরু হলো কামান দাগার আওয়াজ। চলতে থাকল অনেকক্ষণ। এভাবে প্রায়ই এখানে জোরে জোরে বিস্ফোরণ হওয়ার শব্দ পাওয়া যেত। কখনো এর কারণ কেউ জানতে পারেনি। বাকেরগঞ্জের ততকালীন ব্রিটিশ সিভিল সার্জন প্রথম ঘটনাটা লেখেন। বর্ষা আসার আগে আগে গভীর সাগরের দিক থেকে রহস্যময় কামান দাগার আওয়াজ আসতো। ব্রিটিশরা সাগরে জলদস্যু ভেবে খোঁজাখুজি করেও রহস্যভেদ করতে পারে নাই।

 

কীর্তনখোলা নদী

কীর্তনখোলা নদী

ইতিহাসবিদ সিরাজউদ্দিন আহমেদের মতে, একজন ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট, যার নাম হেনরি বেভারিজ, তিনিই সর্বপ্রথম ‘গানস অব বরিশাল’ নামটি ব্যবহার করেন। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত তার লেখা বই ‘ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ‘-এ এই শব্দের ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। এই লেখা থেকে জানা যায়, ফ্রেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসে বরিশাল থেকে দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ শোনা যায়, যা অনেকটা কামান ফাটানোর শব্দ বলে মনে হয়। 

স্থানীয়রা এই শব্দকে ‘বরিশাল কামান’ বলে ডাকতে থাকে। আর তাই তিনিও তার লেখায় এর আওয়াজের নাম দিলেন ‘গানস অব বরিশাল’। কখনো কখনো একটা শব্দ শোনা যেত, আবার কখনো দুই বা তিনটি শব্দ একসঙ্গে শোনা যেত। মজার ব্যাপার হলো, শব্দটা যে আসলে কী এবং এর উৎসটাই বা কী, তা কিন্তু আজো সবার কাছে অজানা।

গানস অফ বরিশাল এর মতো আরো কিছু ঘটনা

১৮৭০-এর দিকে প্রথম বারের মত বরিশাল গানসের কথা নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা যায়। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই এটি শোনা যেত বলে নথিপত্রগুলোতে উল্লেখ করা হয়। ১৮৮৬ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, হরিশপুর প্রভৃতি স্থানে বরিশাল গানস শোনা গেছে। বরিশালের মত ভারতের গঙ্গা নদীর তীর, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, স্কটল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জাপান, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর সাগরসহ আরও কিছু এলাকায় এ ধরনের শব্দ শোনা গেছে।

শব্দ-রহস্য

এই শব্দ-রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা সেই ব্রিটিশদের সময় থেকে শুরু হয়। ইংরেজদের প্রাথমিক ধারণা ছিল, হয়তো ডাচ কিংবা পর্তুগিজ জলদস্যুরাই বরিশালে কোনো গোপন ঘাঁটি করে ভয় দেখানোর জন্য এই আওয়াজ করছে। কারণ মোঘল যুগে বরিশাল-পটুয়াখালী অঞ্চলে পর্তুগীজ এবং ডাচ জলদস্যুদের বেশ তাণ্ডব ছিল। অনেকের ধারণা, পর্তুগিজ জলদস্যুরা একটা খাল খনন করে সাগর থেকে নদীতে আসার জন্য। আর এই খালটি পরবর্তীতে পটুয়াখালী নামে পরিচিতি লাভ করে। তাই ইংরেজদের এমন ধারণা বেশ প্রখর হয়ে ওঠে। শুরু হয়ে যায় খোঁজাখুঁজি। তন্যতন্য করে খোঁজার পরেও কোনো জলদস্যু জাহাজ বা ঘাঁটির খোঁজ বের করতে পারেনি ইংরেজ সৈন্যরা।

পরে ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরের গভীরে হয়তো কোনো আগ্নেয়গিরি রয়েছে। ওই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের শব্দ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয় এটিকে। তবে সম্ভাব্য সব অনুসন্ধানেও এমন কোনো নজির পায়নি ব্রিটিশরা। আরেক দলের যুক্তিতে, সাগরে হয়তো কোনো গ্যাসক্ষেত্র আছে যেটি মৃত। শব্দটা ওই মৃত গ্যাসক্ষেত্র থেকেই আসছে। ব্রিটিশরা সাগরে উপকূল ঘেঁষে অনেক সন্ধান করে কিন্তু কোনো সমাধানে আসতে পারেনি।

এরপর ধারণা করা হয়, সাগর তীরে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে শব্দটা হয়েছে। তবে এমন যুক্তির পক্ষে এখনো পর্যন্ত কোনো জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আরেকটি ধারণা অনুযায়ী কুয়াকাটা, কলাপাড়া ও মঠবাড়িয়া- এই তিন এলাকা সাগরের একটা জায়গায় এসে মিশেছে। জোয়ারের সময় প্রবল ঢেউয়ের কারণে এরকম শব্দ হতো বলেও মনে করা হয়। এখন ওই এলাকায় সাগরের উচ্চতা কম। পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে অনেকটা জায়গা। সে কারণে আগের মতো আর শব্দ পাওয়া যায় না।

 

সুফিয়া কামাল

সুফিয়া কামাল

সুফিয়া কামালের আত্নজীবনীতেও রয়েছে এই ঘটনা

এই বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামাবাড়িতে জন্ম নেন বাঙালি নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ কবি ও সাহিত্যিক বেগম সুফিয়া কামাল। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার আত্নজীবনীমূলক রচনা ‘একালে আমাদের কাল’-এ বরিশাল গানসের কথা উল্লেখ আছে। তার মতে শৈশবে এই ধরনের রহস্যময় বিস্ফোরণের আওয়াজের কথা তিনি তার মামা এবং বয়স্কদের কাছে শুনেছেন। তবে তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, ১৯৫০ সালের পরে আর কেউ এই শব্দ শুনেছেন বলে তিনি শোনেননি।

‘দ্য গানস অব বরিশাল’ ব্যান্ড

অনেকেই হয়তো জানেন না, যুক্তরাষ্ট্রে ‘দি গানস অব বরিশাল’ নামে একটি ইন্সট্রুমেন্টাল ব্যান্ড দল রয়েছে। ২০০১ সালে ‘রেডক্যাপ’ নামক ব্যান্ডটি ভেঙে ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের সিয়াটলে এই ব্যান্ডটি নতুন করে গড়ে ওঠে এই নতুন নামে। তাদের ওয়েবসাইটে এই নামকরণের পেছনের ইতিহাস হিসেবে বঙ্গোপসাগর হতে উদ্ভূত এই শব্দের কথাই বলা হয়েছে।

তবে বরিশাল কামানের শব্দের উৎপত্তির রহস্য জানতে অনেক চেষ্টা করা হলেও এর কার্যকরী কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। তাই অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে আজো সকলের কাছে অচেনা এই ‘গানস অব বরিশাল’ বা ‘বরিশাল কামান’।