• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বরিশাল প্রতিবেদন
ব্রেকিং:
স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশুপালন ও মাংস প্রক্রিয়াকরণের তাগিদ জাতির পিতা বেঁচে থাকলে বহু আগেই বাংলাদেশ আরও উন্নত হতো মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার প্রতি নজর রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রী আজ প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ উদ্বোধন করবেন মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব না খাটানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর দলের নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানায় শেখ হাসিনা মুজিবনগর দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারবে মুজিবনগর দিবস বাঙালির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন: প্রধানমন্ত্রী ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ নতুন বছর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাবে : প্রধানমন্ত্রী আ.লীগ ক্ষমতায় আসে জনগণকে দিতে, আর বিএনপি আসে নিতে: প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা রাষ্ট্রপতির দেশবাসী ও মুসলিম উম্মাহকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কিশোর অপরাধীদের মোকাবেলায় বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের প্রতি বিএনপির কোনো দায়বদ্ধতা নেই : ওবায়দুল কাদের ব্রাজিলকে সরাসরি তৈরি পোশাক নেওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর জুলাইয়ে ব্রাজিল সফর করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী আদর্শ নাগরিক গড়তে প্রশংসনীয় কাজ করেছে স্কাউটস: প্রধানমন্ত্রী

ঘাতক ব্যাধি এইডস্ - প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বরিশাল প্রতিবেদন

প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০১৮  

এইডস্ গোড়ার কথাঃ   এইডস্ - এক ঘাতক ব্যাধির নাম। এখন পর্যন্ত রোগটির কোন কার্যকর প্রতিষেধক কিংবা প্রতিরোধক আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। অথচ এ রোগটি আশ্চর্য দ্রুততায় বিশ¡জুড়ে বসিয়েছে তার মরণ কামড়। মাত্র ৩৭ বছর আগে ১৯৮১ সালে এইডস্ প্রথম নির্ণয় করা হয় দক্ষিণ আমেরিকায় পুরুষ সমকামীদের দেহে। তবে তার আগেই সম্ভবত এ রোগটি ১৯৭৭-৭৮ সালে আমেরিকা, হাইতি ও আফ্রিকায় প্রথম দেখা গিয়েছিল। পরে ১৯৮১ সালে আমেরিকার  Center for Disease Control (C D C) প্রথম এইডস্ রোগের সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠা করে।  

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এইডস্ঃ   এইডস্ রোগের আবিষ্কার মাত্র কয়েক বছর হলেও এরই মধ্যে এ ঘাতক ব্যাধিটি তার ভয়াল থাবা বিস্তার করেছে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। এখন পর্যন্ত ১৬৪টি দেশে এইডস্ রোগ সনাক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্র সংঘের হিসাব অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে ৩ কোটির বেশী এইডস্ রোগী আছে। প্রতিবছর নতুন করে প্রায় ২৭ লাখ লোক এইচআইভি বা এইডস্ আক্রান্ত হচ্ছে। আর গত তিন দশকে আড়াই কোটিরও বেশী মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। তাই আক্ষরিক অর্থেই সমগ্র পৃথিবীর জন্যে এইডস্ এখন এক বিরাট হুমকি।     

এইডস্ - এই দেশেঃ    এইডস্কে  প্রথম দিকে পশ্চিমা দুনিয়ার রোগ বলে ভাবা হলেও গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ সব দিকেই রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে নীরবে। আমাদের মহাদেশেও রোগটি ঢুকে পড়েছে কয়েক বছর আগে। ১৯৮৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মহাদেশের প্রথম রোগীটির সন্ধান মিলেছিল। এখন থাইল্যান্ড, ভারত, নেপাল, মায়ানমার সহ প্রায় প্রতিটা দেশেই আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। এমনকি আমাদের দেশেও কালান্তক এই ব্যাধিটি ঢুকে পড়েছে চুপিসারে। এ দেশে ১৯৮৯ সালে একজন বিদেশী কয়েদীর দেহে এইডস্ ভাইরাস প্রথম পাওয়া যায়। ইউএনএইডসের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে আমাদের দেশে এইচআইভি পজেটিভ মানুষের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার থেকে চৌদ্দ হাজার। যদিও সরকারীভাবে ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২২১ জনকে সনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরই সনাক্ত করা হয়েছে প্রায় ৭০০ জনকে। গত পাঁচ বছরে আক্রান্ত ব্যাক্তির সংখ্যা বেড়েছে পাঁচগুন। তাছাড়া বর্তমানে যোগ হয়েছে এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে থাকা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এইচআইভি পজেটিভ জনগোষ্ঠী।  

এইডস্ কিঃ   সাবধানতার প্রশ্নেই আমাদের এইডস্ সম্পর্কে জানা একান্ত জরুরী। আগেই বলা হয়েছে এইডস্ এক ঘাতক ব্যাধি। এর জন্যে দায়ী এক ধরনের ভাইরাস। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন HIV-Human Immune Deficiency Virus। এটা এক ধরনের রেট্রো-ভাইরাস। এ পর্যন্ত HIV-1 এবং HIV-2 নামে দুই ধরনের ভাইরাস সনাক্ত করা হয়েছে। এই ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশের পর ক্রমাগত বংশবৃদ্ধি করে লিষ্ফোসাইট (T-lymphocyte) নামক শ্বেতকণিকাকে ক্রমাগত ধ্বংস করতে থাকে। যেহেতু শ্বেত-কণিকা শরীরের রোগ প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার, তাই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে তারা সহজেই যে কোন রোগজীবাণু কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এই যে অবস্থা, এটাই এইডস্ এবং এইডস্ এর নিশ্চিত পরিণাম এখন পর্যন্ত মৃত্যু।       

এইচআইভিঃ  এইচআইভি মানবদেহে প্রবেশের পর ১-১০ বছরের মধ্যে রোগী এইডস্ আক্রান্ত হতে পারে। তবে শরীরে এইচআইভি থাকলেই এইডস্ হয়েছে একথা ভাবা ঠিক নয়, যা আমরা হামেসাই ভেবে বসি। অনেকের দেহেই এইচআইভি বাসা বেঁধে থাকে (এইচআইভি পজেটিভ)। এদের শতকরা ৫০ জনই দ্রুত এইডসে আক্রান্ত হয়। অন্যেরা  AIDS Related complex (ARC) এর শিকার হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইচআইভি আক্রান্তরা ক্রমশ এইডস্ রোগে আক্রান্ত হয়।    
এইচআইভি পরীক্ষা।    এইচআইভি পরীক্ষা এক ধরনের রক্ত পরীক্ষা, যার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয় কোন ব্যক্তি উক্ত ভাইরাসে আক্রান্ত কিনা। এটাকে ঠিক এইডস্ টেস্ট বলা যায় না। কেননা আগেই বলা হয়েছে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়া মানেই এইডস্ আক্রান্ত হওয়া নয়।

    শরীরে প্রবেশের দেড় থেকে তিন মাস পরে পরীক্ষা করলে এইচআইভি ধরা পড়ে। নব-জাতকের ক্ষেত্রে ধরা পড়ে ১৮ মাস পর। তবে যখনই ধরা পড়ুক না কেন, এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তিরা তাদের শরীরে জীবাণু প্রবেশের পর থেকেই অন্যকে সংক্রামিত করতে শুরু করে পুরো দমে। ফলে এইডস্ আক্রান্ত ব্যক্তির জন্যে যে সাবধানতা সেই একই সাবধানতা তাদেরও মেনে চলা উচিত কঠোর ভাবে।      

এইডস্ যেভবে ছড়ায়ঃ

(১)    যৌন মিলন।    এইডস্ রোগ বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ উচ্ছৃঙ্খল এবং অনিয়ন্ত্রিত যৌন জীবন। যেহেতু এইডস্ ভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির শুক্র ও স্ত্রী যৌনাঙ্গরসে বিদ্যমান থাকে তাই যখন আক্রান্ত রোগী কোন সুস্থ নারী বা পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয় তখন তার দেহেও ভাইরাস প্রবেশ করে। যাদের একাধিক যৌন সঙ্গী আছে কিংবা যৌনাঙ্গে ক্ষত আছে তারা সহজেই এইডস্ ছড়ায়।

(২)    রক্ত পরিভরণ।    এইডস্ আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত কোন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে দিলে তার শরীরেও ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়। হিমোফিলিয়ার রোগীদের বারবার রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এরা হতে পারে এইডস্ ভাইরাসের সহজ শিকার। আক্রান্ত ব্যাক্তি কর্তৃক ব্যবহৃত নিডল বা সিরিঞ্জ অন্যরা ব্যবহার করলেও দ্রুত ছড়ায় রোগটি। তাই ড্রাগ গ্রহণকারীরা রোগটির সহজ শিকার  

(৩)    গর্ভবতী মা।    গর্ভবতী মায়ের দেহ থেকে গর্ভস্থ সন্তান কিংবা বুকের দুধ খায় এমন সন্তানও মার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করতে পারে এইডস্।

(৪)    পতিতা, নারী, শিশু।    এইডস্ বিস্তারের আর একটা প্রধান কারণ হচ্ছে পতিতারা। প্রচুর লোকের সঙ্গে পতিতাদের যৌন সম্পর্ক ঘটে বিধায় একজন আক্রান্ত পতিতার মাধ্যমে রোগটি সহজেই বিস্তার লাভ করে। পতিতাদের কাছ থেকে আক্রান্ত হয় তার কাছে আগমনকারী পুরুষেরা। সেই পুরুষদের কাছে থেকে আক্রান্ত হয় তাদের ন্ত্রীরা এবং অন্যান্য নারীরা যারা তাদের যৌন সংসর্গে আসে। নারীদেহ থেকে এইডস্ ভাইরাস আবার যায় তাদের গর্ভের সন্তান কিংবা দুগ্ধপোষ্য শিশুদের দেহে। মনে রাখতে হবে ন্ত্রী পতিতার পাশাপাশি পুরুষ পতিতাও রোগটির বাহক। বলা চলে বেশি মাত্রায় বাহক। কেননা একজন পুরুষ একজন নারীর তুলনায় ২/৩ গুন বেশি এইচআইভি ছড়াতে সক্ষম। আমরা পুরুষ পতিতা শব্দটির সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত নই, এদেশে তাদের সংখ্যাও অতি কম। তবে তারা আছে। ইতিমধ্যেই রমনা পার্কে এদের দু'একটি গ্যাংয়ের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে।         

যাদের এইডস্ হওয়ার সম্ভাবনা বেশিঃ

(১)    সমকামী পুরুষ/ বহুগামী পুরুষ- ৬০% ।
(২)    ড্রাগ আসক্ত লোকজন যারা একই সিরিঞ্জ অনেকে ব্যবহার করে-২৩%।
(৩)    হিমোফিলিয়া বা যে সমস্ত অসুখে বারবার রক্ত নিতে হয় কিংবা যে সমস্ত ওষুধ তৈরীতে রক্ত ব্যবহার করা হয়, সেই ওষুধ ব্যবহারকারী-৩%।

(৪)    এইডস্ আক্রান্ত কোন পুরুষ বা নারীর যৌন সঙ্গী (নারী বা পুরুষ)-৬০%।
রোগের লক্ষণ।    আমাদের মত দরিদ্র একটা দেশে অধিকাংশেরই পক্ষে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা কিংবা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ থাকে না। আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা সচেতনতা বোধের অভাবেও আমরা পর্যদুস্ত। ফলে ঘাতক এই ব্যাধিটির হাত থেকে নিস্কৃতি পেতে আমাদের সবারই অন্তত উচিত হবে রোগ লক্ষণ, প্রতিরোধের উপায় প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা। প্রথমেই রোগের লক্ষণঃ

(১)    প্রধান লক্ষণঃ

1)    অকারণে শরীরের ওজন কমে যাওয়া।
2)    দীর্ঘস্থায়ী জ্বর।
3)    দীর্ঘ দিন ধরে ঘন ঘন ডায়রিয়া।
4)    গ্লান্ড বা গ্রস্থি ফুলে যাওয়া।
5)    যকৃত বা প্লীহা স্ফীত হওয়া প্রভৃতি।
    
(২)    গৌণ লক্ষণঃ

1)    দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগ।   
2)    ক্রমাগত হারপিস ব্যাধি।
3)    মুখ ও গলায় ছত্রাক জাতীয় ঘা।
4)    মুখ ও যৌনাঙ্গে বেগুনী রঙের ক্ষত।

5)একটানা কাশি।  
6)    স্নায়ুর  ক্ষতি।
7)    স্মরণশক্তি কমে যাওয়া ও বুদ্ধিমত্তা লোপ।

    তবে এই লক্ষণগুলোর কোন একটার প্রকাশ শরীরে দেখলেই ভেঙ্গে পড়াটা ঠিক হবে না। কেউ যদি এমন কিছু করে থাকেন যাতে তার এইডস্ হতে পারে এবং তার শরীরে এ লক্ষণগুলোর ২/১টি প্রকাশ পায় তবে আর দেরি না করে সে ব্যক্তির উচিত হবে তক্ষুণি এইচআইভি পরীক্ষা করা। এছাড়া সুযোগ থাকলে সকলেরই উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।  

প্রতিষেধক নেই।    এইডস্ আবিষ্কারের পর থেকেই বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এর প্রতিষেধক  আবিস্কার করার জন্যে। অথচ দুঃখজনক সত্যি হলো এখন পর্যন্ত তারা তেমন কোন সফলতার মুখ দেখেননি। এক পর্যায়ে তারা এজেডটি (তরফড়ুঁফরহ অতঞ) নামের একটা ওষুধ আবিস্কার করেন। বিরাট প্রত্যাশা জাগালেও ওষুধটি আসলে এইডস্ রোধে ব্যর্থ হয়। তবে এটা এইডস্রে উপসর্গ আড়াই থেকে চার বছর পিছিয়ে দিতে পারে। বর্তমানে কোয়ার্ড, বাইরাড, ভরিনোস্টেটেক, অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ড্রাগ প্রভৃতি ওষুধ আক্রান্তদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। পরিশ্রম, অর্থব্যয়, অক্লান্ত সাধনা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি। পারেননি কোন প্রতিরোধক আবিষ্কার করতে। তবে আশার কথা, তাঁরা হতাশ হননি। চলছে নিরলস প্রচেষ্টা। এক দিন না এক দিন তারা নিশ্চয়ই জয় করবেন ঘাতক এ ব্যাধিটিকে।   
প্রতিরোধ করা যায়।    এইডস্ প্রতিরোধ করা যায়। একটু সাবধানী এবং মনোযোগী হয়ে আমরা যদি এড়িয়ে চলি এইডস্ হওয়ার কারণ সমূহকে তাহলেই নিশ্চিত প্রতিরোধ করা যাবে এ রোগটি। আমাদের অনেকের মনেই একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে এইডস্ বুঝি ছোঁয়াচে। এ ধারনা পুরোটাই ভূল। এইডস্ কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। এইচআইভি সাধারণত রক্ত, বীর্য, ভেজাইনাল ও সারভিক্যাল ক্ষরণ, মাতৃদুগ্ধ প্রভৃতিতে প্রচুর পরিমাণে থাকে। মূত্র, লালা ও চোখের পানিতে থাকে অল্প পরিমাণে। তবে এসব থেকে তা সংক্রামিত হতে পারে না।

    সুতরাং, এইডস্ রোগীদের ভয় পাওয়ার বা ঘৃণা করার কোন মানেই হয় না। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি নিুলিখিত উপায়ে কখনও এইচআইভি বা এইডস্ ছড়ায় নাঃ

(১)    এক পরিবারে বসবাস, খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, খেলাধুলা, করমর্দন বা চুম্বন, কোলাকুলি, পোশাক-পরিচ্ছদ বা এক টয়লেট ব্যবহারে।

(২)    মলমূত্র, হাঁচি-কাশি, থুথুর মাধ্যমে।
(৩)    খাদ্য, পানি বা বায়ূর মাধ্যমে।
(৪)    মশা-মাছি বা অন্য কীটপতঙ্গের মাধ্যমে।
(৫)    চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে রোগীর পরিচর্যায়।
    
অথচ এরপরও এইডস্ বাড়ছে মারাÍক হারে। এর জন্যে অবশ্যই আমরা দায়ী। দায়ী আমাদের অজ্ঞতা, দায়িত্বহীন অসংযত জীবন যাপন এবং অবহেলা।

বাংলাদেশও হতে পারে সহজ স্বীকার।    বাংলাদেশে এইডস্ রোগীর সংখ্যা কম দেখে আমাদের তৃপ্ত হওয়ার কিছুই নেই। দারিদ্র, অবহেলা, অজ্ঞতা, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রভৃতির অভাবের ফলে আমরা আসলে হয়তো আদৌ প্রকৃত এইচআইভি বাহক বা এইডস্ রোগীর সংখ্যা জানতেই পারিনি। উপরন্তু এদেশ হতে পারে এইডস্রে সহজ টার্গেট। কিভাবে ? দেখা যাকঃ

(১)    প্রতিবেশী রাষ্ট্র কর্তৃক সংক্রমণ।    বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, নেপাল প্রভৃতি দেশে এইডস্ ছড়িয়ে পড়েছে বহুল পরিমান। সেসব দেশ থেকে সীমান্তের জনগণ এবং অন্যান্যভাবে আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পারে এইডস্।

(২)    পতিতার মাধ্যমে।    এইডস্ ছড়াবার আর একটা প্রধান মাধ্যম হচ্ছে পতিতালয় এবং পতিতারা। এশিয়ার উন্নয়নশীল অনেক দেশের মতই আমাদের দেশেও রয়েছে পতিতা সমস্যা, ঢাকার রাজপথে ভাসমান শিশু পতিতার সংখ্যাই ১ লাখের বেশী। এ থেকেই উপলদ্ধি করা যায় সারা দেশের অবস্থা। দেশের বৃহত্তম পতিতালয় টানবাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার পুরুষ ছুটে আসে শরীরী সুখের সন্ধানে। পতিতাদের সবাই প্রায় দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং নানা যৌন রোগে আক্রান্ত। অশিক্ষা, মানবেতর জীবন-যাপন, দারিদ্রের সুতীব্র কষাঘাত এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে তারা এমনকি নিজেদের অসুখ-বিসুখ সম্পর্কেও অজ্ঞ। সুতারাং, তাদের কাছ থেকে যে হাজারো কিশোর, যুবক, প্রৌঢ় এইচআইভি সহ নানা যৌন রোগের সওদা কিনে ঘরে ফিরবে তাতে আর আশ্চর্য কি ! এবং এই সব সংক্রমিত পুরুষেরা আবার এই এইচআইভি সহ নানা যৌন রোগের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে সক্ষম নিজ পরিবারসহ সমাজের আনাচে-কানাচে।

(৩)    বিদেশে চাকরি/বিদেশী নাগরিক।    যে সমস্ত বাংলাদেশী বিদেশে চাকরি বা নানা কার্যোপলক্ষ্যে অবস্থান করেন তারা এবং বিদেশী নাগরিক যারা এ দেশে অবস্থান করেন তারা উভয়ই ছড়াতে পারেন এরোগ। কেননা তাদের এ রোগের বাহক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

(৪)    ড্রাগ আসক্তদের মাধ্যমে।    এ দেশের বেকার তরুণ সমাজ হতাশা এড়াতে ক্রমশ ড্রাগে আসক্ত হয়ে পড়ছে। অনেকে স্রেফ ফ্যাশান হিসাবে কিংবা মন্দ সঙ্গের পাল্লায় পড়েও গ্রহণ করছে ড্রাগ। কলেজ বিশ¡বিদ্যালয়েগুলোতে ড্রাগ গ্রহনকারীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে বেড়েই চলেছে। এরা একই নীডল অনেকে ব্যবহার করে বলে তাদের মধ্যে এইডস্ বিস্তারের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে।

(৫)    রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাধ্যমে।    মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ ছিন্নমূল রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। ধারণা করা হয় তাদের মধ্যে প্রায় ৫০০০ এইচআইভি পজেটিভ আছে। এখনই চিহ্নিত এবং সাবধানতা অবলম্বন না করতে পারলে আক্রান্ত এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাধামে রোগটি ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

(৬)    ধর্মে অনীহা।    ধর্মের প্রতি অনীহা এবং যৌন জীবন সম্পর্কে একদিকে অজ্ঞতা অন্যদিকে মানুষের তথাকথিত উদার ও পশ্চিমা দৃষ্ঠিভঙ্গি আমাদের দেশের এক শ্রেনীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ রোগ বিস্তারের কারণ হতে পারে।

(৭)    অজ্ঞতা।    বাংলাদেশ তৃতীয় বিশে¡র দরিদ্র এবং স্বল্পশিক্ষিত একটি দেশ। শিক্ষাহীনতা, দারিদ্র এবং প্রচারণার অভাবে এ দেশের অনেকেই এখনও এইডস্রে নামই শোনেননি। যারা রোগটির নামই শোনেননি আমরা তাদের কাছ থেকে প্রতিরোধ আশা করব কেমন করে? সুতরাং সচেতন সমাজ এবং সরকারকেও একই সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর পদক্ষেপ।      
         
আমাদের করণীয়।     এইডস্ প্রতিরোধে আমাদের সকলের আন্তরিক ইচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নিুলিখিত কাজগুলো আমরা সহজেই করতে পারিঃ

(১)    সকল প্রকার অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক, বিকৃত যৌনাচার, সমকামিতা, একাধিক যৌন সঙ্গী প্রভৃতি পরিহার করা।

(২)    পতিতা কিংবা পতিতালয় থেকে দূরে থাকা, অবৈধ যৌন সম্পর্ক পরিহার করে মাত্র এক জনের সঙ্গে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক (বিশ¡স্ত সঙ্গী হতে হবে) বজায় রাখা।

(৩)    রক্ত বা রক্তজাত ওষুধ ব্যবহারের আগে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া তা এইচআইভি মুক্ত।

(৪)    সব সময় ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করা। তা না পারলে নীড্ল ২০-৩০ মিনিট ফুটন্ত পানিতে ফুটিয়ে ব্যবহার করা।

(৫)    ড্রাগ কিংবা রক্তনালীতে নেশাকারক দ্রব্য গ্রহণে সম্পূর্ণ বিরত থাকা।

(৬)    শল্য চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার নিশ্চিত করা। চঁনষরপ ংবৎারপব এ ব্যবহƒত হয় এমন যন্ত্রপাতি (নাক-কান ফোঁড়ানো যন্ত্র, খাৎনার যন্ত্র, সেলুন দাড়ি কাটার ব্লেড কিংবা ক্ষুর প্রভৃতি) ব্যবহার না করা কিংবা অনন্যোপায় হলে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার।

(৭)    বিদেশে একাকী অবস্থানকালে যৌনসঙ্গী পরিহার করা।

(৮)    শিশু কিশোরদের Reproductive system সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দান করে দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত দিক থেকে তাদের প্রস্ত‘ত ও সচেতন করে তোলা।

(৯)    সর্বোপরি ধর্মনিষ্ঠ ইসলামিক জীবন-যাপন আমাদের এইডস্ থেকে দূরে রাখতে পারে।

এইডস্ প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেও। মনে রাখতে হবে সরকারী কার্যক্রম শুধুমাত্র রেডিও টিভিতে ২/৪টি আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন, প্রচার পত্র বিলি কিংবা বিজ্ঞাপনী সাইন-বোর্ডের মধ্যে সীমিত রাখলে চলবে না। এগুলো যেমন জোরদার করতে হবে তেমনি গ্রহণ করতে হবে সুদূর প্রসারী ব্যাপক পরিকল্পনা। যেমনঃ

(১)    পতিতালয় উচ্ছেদ করে পতিতাদের সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া। কিংবা তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা।

(২)    শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে দেশের প্রতিটা মানুষকে সচেতন করা। পাঠ্য-পুস্তকে প্রয়োজনীয় যৌন শিক্ষা অন্তর্ভূক্ত করা এবং গণশিক্ষায়ও এসব রোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট আলোচনা অন্তর্ভূক্ত করা।

(৩)    সবার জন্যে স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করা। বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো এবং এইডস্ রোগীরা যেন রোগ ছড়াতে না পারে তার জন্যে যথাযথ ব্যবস্থ গ্রহণ।

(৪)    বহুবিবাহ রোধ বিষয়ক যে আইন আছে তা যথাযথ ভাবে কার্যকর করা।

(৫)    দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়া। যেন তারা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সুযোগ এবং চিকিৎসার সঙ্গতি অর্জনে সক্ষম হয়।

(৬)    আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া, তাদের সচেতন করে তোলা। সর্বোপরি তারা যেন স্থানীয় জনগণের মধ্যে মিশে গিয়ে রোগটি না ছড়ায়- সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।  

এইডস্ হলে।    অপর্যাপ্ত জ্ঞান এবং ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে আমরা এইচআইভি এবং এইডস্ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভয় পাই। কিন্তু তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একবার ভেবে দেখুন আমাদের এই মনোভাবের ফলে এ দেশের এইচআইভি বহনকারী অনেকেই অপমান, নিরাপত্তাহীনতা এবং অবহেলার ভয়ে তাদের অসুখের কথা গোপন করে রেখেছে, কিংবা কোন রকম চিকিৎসা ছাড়াই লুকিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। হতে পারে সে আপনার স্বামী, বাবা, বোন কিংবা সন্তান। অনেকে রোগ নির্ণয়ের অভাবে তাবিজ-কবজ বা ঝাড়ফুকের আশ্রয় নিচ্ছে কিংবা নিতান্ত অবহেলায় কাটাচ্ছে জীবন।

    এ অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। একজন এইডস্ রোগীর দরকার সেবা, সহমর্মিতা এবং চিকিৎসা। দরকার প্রাথমিক শুশƒ্রষা, পুষ্টিকর খাবার, পরিমিত ব্যায়াম। আমাদের দরদী মন এবং আন্তরিক হাতই তাঁদেরকে যোগাতে পারে এসব।

    অন্যদিকে এইডস্ হলে কিংবা এইচআইভি পজেটিভ হলে আক্রান্তদেরও সাবধান হতে হবে। পরিহার করতে হবে সে সমস্ত কাজ যার মাধ্যমে এইচআইভি ছড়ায়। যেমন- রক্তদান, আক্রান্ত হলে সন্তান গ্রহণ কিংবা সন্তানকে স্তন্য দান, যৌন মিলন প্রভৃতি। এছাড়া আক্রান্ত হলে যে কাজটি অবশ্যই করতে হবে তা হলো যৌন-মিলনের ক্ষেত্রে কনডম ব্যবহার করা বা ব্যবহার নিশ্চিত করা। মনে রাখবেন স্বাভাবিক অবস্থাতেও যৌন মিলনের ক্ষেত্রে কনডম আপনাকে বাঁচাতে পারে এইডস্ থেকে।
এইচআইভি পরীক্ষা - আমাদের দেশে।    আমাদের দেশে এইচআইভি পরীক্ষা করার সুবিধা কম হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। সুতরাং সন্দেহ হলে বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে এইচআইভি শরীরে আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা।

বিনামূল্যে যে সব জায়গায় এই পরীক্ষা করা হয় সেগুলো হলোঃ

(১)    ভাইরোলজি বিভাগ, আই পিজি এম আর, শাহবাগ, ঢাকা।
(২)    মাইক্রোবায়োলজী বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, মহাখালী, ঢাকা।
(৩)    আর্মি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, ঢাকা।
(৪)    বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো প্রভৃতি।

শেষ কথাঃ   এদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় রোগটি এখানে একবার ডাল-পালা মেলতে শুরু করলে তাকে প্রতিরোধ করা যাবে না কোন মতেই। তাই গোড়াতেই একে প্রতিরোধ করা দরকার। সে লক্ষ্যে চায় আÍিক সূচিতা, সুস্থ জীবন-যাপন, ধর্মীয় মূল্যবোধ। চাই দেশব্যাপী প্রচারণা, সচেতনতা এবং গণমত। তাই আসুন আমরা সকলে সার্বিক অংশ গ্রহণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকরী করার মাধামে এইডস্ মুক্ত থাকার অঙ্গীকার করি। এখনই!