• মঙ্গলবার ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ||

  • অগ্রহায়ণ ১৯ ১৪৩০

  • || ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

বরিশাল প্রতিবেদন
ব্রেকিং:
অবসরের তিন বছরের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তারা নির্বাচন করতে পারবে না বস্ত্র খাতের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে : রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বস্ত্রখাতের অবদান অপরিসীম : প্রধানমন্ত্রী শেখ ফজলুল হক মনির ৮৫তম জন্মদিন আজ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয় : রাষ্ট্রপতি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয় : প্রধানমন্ত্রী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল দেশের বিভিন্ন স্থান পার্বত্য শান্তি চুক্তি বিশ্বে একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত: রাষ্ট্রপতি পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ঘটনা তরুণদের মুখোমুখি সজীব ওয়াজেদ জয় বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজউইকে শেখ হাসিনার নিবন্ধ ক্লাইমেট মোবিলিটি চ্যাম্পিয়ন লিডার পুরস্কার পেলেন প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য সুন্দর নির্বাচন বঙ্গবন্ধু টানেলে ৩০ দিনে টোল আদায় ৪ কোটি টাকা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি অব্যাহত সমর্থন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী মানুষের গতিশীলতায় জলবায়ুর প্রভাব: ৫ পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর মোহাম্মদ হানিফ তাঁর কর্মের মাধ্যমে জনগণের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন : রাষ্ট্রপতি দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে মোহাম্মদ হানিফ মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন আজীবন : প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশ্বে বাংলাদেশ অনুকরণীয়: প্রধানমন্ত্রী

জেল খেটেছেন, চাকরি হারিয়েছেন, তবু দমে যাননি সাখাওয়াত

বরিশাল প্রতিবেদন

প্রকাশিত: ৩ নভেম্বর ২০২২  

পরিবার থেকে অবহেলিত বৃদ্ধ মানুষের কথা চিন্তা করে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন বরিশালের সাখাওয়াত হোসেন। এটি করতে গিয়ে জেল খেটেছেন এবং চাকরি হারিয়েছেন। তবু দমে যাননি। এখন পথেঘাটে হেঁটে দানবাক্স হাতে টাকা তুলে বৃদ্ধাশ্রম চালাচ্ছেন।

সাখাওয়াত হোসেন বাকেরগঞ্জ উপজেলার এসকান্দার আলী খলিফার ছোট ছেলে। তিন ভাই, এক বোন ও বাবা-মাকে নিয়ে ছিল তাদের সংসার। অনেক কষ্ট করে সন্তানদের বড় করেছেন। কিন্তু দুই ছেলে এক মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মা-বাকে ভরণপোষণ দেওয়া বন্ধ করে দেন। এতে অসহায় হয়ে পড়েন বাবা-মা। তখন ঢাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন সাখাওয়াত। কিন্তু ওই বেতনে বাবা-মা ও সংসার চালানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।’

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‌‘২০১৪ সালের দিকের ঘটনা। সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও ভাইবোনের কাছ থেকে অবহেলিত হয়ে পড়েন বাবা-মা। তারা বাবা-মাকে ভরণপোষণ দিতো না। খুব কষ্ট করে চলতে হতো। তিনবেলা খাবার ও বাবা-মাকে ওষুধ পর্যন্ত দিতো না। বাবা-মায়ের দুর্বিষহ জীবনযাপনের অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এত অল্প বেতনে সংসার চালানো আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন আমার অবর্তমানে বাবা-মায়ের কি হবে সে পথ খুঁজছিলাম। ভবিষ্যতে আমারও একই অবস্থা হবে—এমন কথা ভাবছিলাম। এটি আমাকে খুব নাড়া দেয়। এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় আসে। ২০১৫ সালে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে বাকেরগঞ্জ উপজেলার একটি ভাড়া বাসায় উঠি। ওই বছর সেখানে ছোট পরিসরে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলি। সেখানে চার জন বৃদ্ধকে তুলি। ঢাকায় চাকরি করে যে টাকা পেতাম তা বৃদ্ধাশ্রমের কাজে খরচ করতাম। পাশাপাশি আমার স্ত্রী চাকরি করে যা পেতেন তা দিয়ে সংসার চলতো। এরই মধ্যে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার বিষয়টি জেনে আমাকে বরখাস্ত করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান।’ 

তিনি বলেন,‘এরপর বৃদ্ধাশ্রম কীভাবে চলবে সেজন্য চাকরি খুঁজতে থাকি। অনেক ঘোরাঘুরির পর চাকরি না পেয়ে ডাব বিক্রির সিদ্ধান্ত নিই। ছয় মাস ঢাকায় ডাব বিক্রি করেছি। সে টাকায় বৃদ্ধাশ্রম চালিয়েছি। তবে ডাব বিক্রির কথা আমার পরিবার জানতো না। পরে জেনে উৎসাহ দেন বাবা-মা। ২০১৬ সালে বৃদ্ধাশ্রমের অনুমোদন চেয়ে সমাজসেবা অধিদফতরে আবেদন করি। এরপর অনুমোদন পাই। বিষয়টি জেনে যান আমার দুই ভাই ও বোন। তখন মেজো ভাই ফারুক হোসেন ও বড় ভাই সাইদুর রহমান বৃদ্ধাশ্রমের জন্য জমি কিনে দেওয়ার কথা বলেন। কয়েক মাস পর বৃদ্ধাশ্রমের জন্য জমি কেনায় সহায়তার কথা বলে আমার কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নেন। পরে আরও ৫০ হাজার টাকা নেন। আজ পর্যন্ত টাকা এবং জমি কিছুই দেননি।’

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এতে করে বৃদ্ধাশ্রমের জমি কেনা পিছিয়ে যায়। এমনকি বৃদ্ধাশ্রমটি টিকিয়ে রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২০২০ সালে আমার মা মারা যান। কয়েক মাস পর বাকেরগঞ্জ থেকে সরিয়ে নগরীর কাউনিয়া হাউজিং এলাকার ভাড়া বাসায় বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আসি। বর্তমানে এখানে আমার বাবাসহ ২০ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন। তাদের খাবার, চিকিৎসা এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র জোগাড় করতে হাতে তুলে নিয়েছি দানবাক্স। বাক্সের গায়ে লাগানো হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমের লোগো। বাক্স নিয়ে বরিশাল নগরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সড়কে হেঁটে বেড়াই। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টাকা তুলি। সে টাকায় চলে বৃদ্ধাশ্রম।’

দানবাক্স হাতে টাকা তুলতে গিয়ে নির্মম অভিজ্ঞতার কথা জানালেন সাখাওয়াত। তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের শেষদিকে ঢাকায় দানবাক্স নিয়ে টাকা তোলার সময় এক পুলিশ সদস্য আমাকে চাঁদাবাজ বলে আটক করে নিয়ে যান। এজন্য দুদিন জেল খেটেছি। নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সদস্যকে বারবার বলেছি, আমি চাঁদাবাজ নই। সমাজসেবা অধিদফতর থেকে আমার বৃদ্ধাশ্রম নিবন্ধনকৃত। কিন্তু পুলিশ সদস্য কোনও কথাই শোনেননি। পরে আদালতে মুচলেকা দিয়ে আমাকে মুক্তি পেতে হয়েছে।’

এখন বরিশালের সবাই আমাকে চেনেন উল্লেখ করে সাখাওয়াত বলেন, ‘এখন আর মানুষজনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না। সবাই জেনেশুনেই নিজ থেকে দানবাক্সে টাকা দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অনেকে আমার মোবাইল নম্বর নিয়ে পরিবারহারা বৃদ্ধদের খবর দেন। খবর পাওয়ার পর তাদের বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে আসি। আরও অর্ধশতাধিক ব্যক্তি বৃদ্ধাশ্রমে আসার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু খাবার, চিকিৎসা এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের সংকট থাকায় তাদের আনা সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে কুমিল্লার এক বৃদ্ধের অবস্থা খুব খারাপ। তাকে দু’একদিনের মধ্যে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে আসবো।’

এদিকে, এলাকাবাসী বৃদ্ধাশ্রমে সহায়তা দিতে শুরু করেছেন। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে বৃদ্ধাশ্রমে খাবার সরবরাহ করা হয়। সাখাওয়াত নগরীর স্টিমারঘাট সংলগ্ন কাঁচা বাজার থেকে পাইকারিতে শাকসবজি কেনেন। তখন বিক্রেতারাও তাকে সহায়তা দেন।

কাঁচা বাজারের সবজি বিক্রেতা জসিম উদ্দিন ও জাকির হোসেন বলেন, সাখাওয়াতের বৃদ্ধাশ্রমে গেছি আমরা। সেখানের বৃদ্ধরা হাতে খাবার পর্যন্ত খেতে পারেন না। তাদের খাবার থেকে শুরু করে সব সেবাযত্ন করেন সাখাওয়াত। এজন্য আমরা সাধ্যমতো তাকে সহায়তা করি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, ‘সাখাওয়াতের বৃদ্ধাশ্রমের বিষয়টি আমি জানি। এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার বৃদ্ধাশ্রমের জন্য অনুদান প্রয়োজন। কেউ সহায়তার হাত বাড়ালে এখানের বাসিন্দারা সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন।’

বরিশাল সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক আল মামুন তালুকদার বলেন, ‘সাখাওয়াতের বৃদ্ধাশ্রমটি পরিদর্শন করেছি। এটি আমাদের অধিদফতর থেকে নিবন্ধনকৃত। এজন্য সাখাওয়াতকে বছরে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। তবে ওই সহায়তা দিয়ে এক মাসও চলে না। বৃদ্ধাশ্রমটি যাতে সুন্দরভাবে চলে সেজন্য আমাদের দফতর থেকে যতটা সম্ভব সহযোগিতা করবো। একইসঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমটি যাতে বছরে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পায় সে বিষয়টি দেখবো।’